Islamic

রমজান মাসের ফজিলত ও মর্যাদা

হিজরী বর্ষের নবম মাস রমজান। রমজানের অর্থ পুড়ে ফেলা, ধ্বংস করা, নিশ্চিহ্ন করা, রোদের প্রখরতা, উত্তাপতা ইত্যাদি। লিসানুল আরব আভিধান গ্রন্থে এসেছে যে, ‘রমজান’ হচ্ছে কঠিন পিপাসার কারণে পেটের মধ্যে অনুভূত জ্বালা বা যন্ত্রণা। কারো কারো মতে, রমজান হলো এমন একটি ইবাদত, যা মানুষের কৃত পাপগুলোকে পুড়িয়ে ফেলে। দীর্ঘ এগারটি মাস পরে মাহে রমজানের সিয়াম সাধনায় মানবদেহের অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা কু-রিপুগুলো পুড়ে ছাই হয়ে যায় এবং রোজার প্রভাবে মানবের ভেতর-বাহির কালিমামুক্ত হয়ে রোজাদার ব্যক্তি একজন  খাঁটি সোনার মানুষে পরিণত হয়ে যায়।সাহাবাদের উদ্দেশ্যে এভাবে ঘোষণা দিতেন বিশ্বনবি সাল্লাল্রাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-
أتاكم رمضان شهر مبارك
‘তোমাদের দরজায় বরকতময় মাস রমজান এসেছে।’

রমজান মাসের ফজিলত

মাহে রমজান নানাবিধ কারণে অতীব গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় একে ‘সাইয়্যেদুস শুহুর’ তথা মাসসমূহের সরদার বলা হয়। এ মাসের নাম পবিত্র কুরআন মজীদের সূরা বাকারার ১৮৫ নম্বর আয়াতে উল্লেখ রয়েছে। এ মাসে পবিত্র কুরআন মজিদ নাজিল হওয়ায়  প্রতিটি মুসলমানের নিকট মাসটি অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ। এ মাসের প্রধান ইবাদত হলো ‘সিয়াম সাধনা’ বা দিনভর রোজা পালন করা।

রমজান মাসের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এ মাসজুড়ে রোজা পালন করা ফরজ। কুরআনুল কারিমের রোজা পালনের নির্দেশ এসেছে এভাবে-
فَمَن شَهِدَ مِنكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ
‘কাজেই তোমাদের মধ্যে যে লোক এ মাসটি পাবে, সে এ মাসের রোযা রাখবে।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ১৮৫)

মাহে রমজানের ফজিলত

রমজান হিজরি সনের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম মাস, সবচেয়ে বেশি ফজিলতের মাস, সবচেয়ে বেশি সওয়াব অর্জনের মাস। আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ এক নেয়ামত স্বরূপ বান্দার জন্য শ্রেষ্ঠ উপহার এই মাহে রমজান।
আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের সকল কাজের যেমন পূর্ব প্রস্তুতি থাকে তেমনি রমজানের জন্য আমাদের সার্বিক  প্রস্তুতি নিতে হবে। দুনিয়ার যত ঝামেলা আছে, রমজান আসার আগেই সে সব ঝামেলা থেকে মুক্ত হয়ে যাব ইনশাল্লাহ। অন্তত এতটুকু মুক্ত হয়ে যাব যে, রমজানের রোজা রাখতে এবং অন্যান্য ইবাদাত যেমন- তরাবীহ্ পড়া, কুরআন তেলাওয়াত করা ইত্যাদির জন্য কোনো বাধা না থাকে। রমজানের জন্য আগে থেকেই এরকম প্রস্তুতি নেওয়ার দিকে ইঙ্গিত করে রাসূল (সা.) বলেছেন, দেশের শুরু থেকেই দিন গণনা করতে হবে এবং সে মোতাবেক আস্তে আস্তে রমজানের দিকে অগ্রসর হতে হবে।প্রতিটি মুসলমানের উচিত নিজেদের আল্লাহর কাছে নিবেদন করতে রমজানের আগেই যথাযথ প্রস্তুতি গ্রহণ করা। রমজান পরবর্তী আমরা যেন একেবারে নিষ্পাপ শিশুর ন্যায় হতে পারি তার জন্য আমাদের পরিপূর্ণভাবে সকল প্রস্তুতি নিতে হবে।  রমজান উপলক্ষে আমরা যে সকল প্রস্তুতি নিব তা নিম্নে দেওয়া হল:-

মাহে রমজানের শারীরিক প্রস্তুতি: পুরো রমজান যেন আমরা সুস্থ ভাবে রোজা রাখতে পারি তার জন্য আমাদের আগে থেকেই খাওয়া-দাওয়া ও ঘুমের বিষয়ে সচেতন হতে হবে। প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে এবং সেই মোতাবেক চলতে হবে শরীর সুস্থ থাকলে আমরা রমজানে পরিপূর্ণভাবে আমল করতে পারব।

> লাইলাতুল কদরের মাস
এ মাসের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো ‘লাইলাতুল কদর’। রাতটি হাজার মাসের (৮৩ বছর ৪ মাস) ইবাদতের চেয়েও উত্তম। এ রাতে কুরআনুল কারিম নাজিল করা হয়েছে। রমজানের শেষ দশকের বেজোড় যে কোনো একটি রাতই ‘লাইলাতুল কদর’। আল্লাহ তাআলা বলেন-
– وَالْكِتَابِ الْمُبِينِ – إِنَّا أَنزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةٍ مُّبَارَكَةٍ إِنَّا كُنَّا مُنذِرِينَ
শপথ সুস্পষ্ট (কুরআনের) কিতাবের। আমি একে নাজিল করেছি এক বরকতময় রাতে। নিশ্চয়ই আমি সতর্ককারী।’ (সুরা দুখান : আয়াত ২-৩)
– إِنَّا أَنزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةِ الْقَدْرِ- وَمَا أَدْرَاكَ مَا لَيْلَةُ الْقَدْرِ – لَيْلَةُ الْقَدْرِ خَيْرٌ مِّنْ أَلْفِ شَهْرٍ – تَنَزَّلُ الْمَلَائِكَةُ وَالرُّوحُ فِيهَا بِإِذْنِ رَبِّهِم مِّن كُلِّ أَمْرٍ – سَلَامٌ هِيَ حَتَّى مَطْلَعِ الْفَجْرِ
‘আমি একে (কুরআনকে) নাজিল করেছি লাইলাতুল কদরে। আপনি কি জানেন কি লাইলাতুল কদর কী? লাইলাতুল কদর হল এক হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। এতে প্রত্যেক কাজের জন্যে ফেরেশতাগণ ও রূহ অবতীর্ণ হয় তাদের পালনকর্তার নির্দেশক্রমে। এটা নিরাপত্তা, যা ফজরের উদয় পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। সুরা কদর : আয়াত ১-৫)

মাহে রমজানে পরিবারে প্রস্তুতি: পরিবারের সদস্যদের রমজানের প্রতি আগ্রহী করে তোলার জন্য রজব মাস থেকে রোজার ফজিলত বিষয়ে হাদিস সমূহ আলোচনা করা। রমজান মাসে পারিবারিকভাবে কে কোন কাজে  সহযোগিতা করবে সে বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করা, আমলের সময় এবং তার জন্য জরুরী কাজ গুলো কিভাবে সেরে নেবে তা সবাই মিলে আলোচনা করা । সবাই সবাইকে সহযোগিতা করার মানসিকতা তৈরি করা।

মাহে রমজানে গুনাহ ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তুতি: জাহান্নাম থেকে নিজেকে বাঁচাতে নিজের জীবনেরগুনাহগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো ছেড়ে দিয়ে একজন নিষ্পাপ মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে বদ্ধপরিকর হতে হবে এবং সে হিসেবে আমল করতে থাকতে হবে । বারে বারে নিজের কৃতকর্মের বিষয়গুলো মনে করে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে।

মাহে রমজানে সামাজিক প্রস্তুতি:  রমজানের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে প্রতিবেশী ও সমাজের লোকজনের সাথে  রমজানের বিভিন্ন ফজিলত ও ইতিবাচক দিক নিয়ে আলোচনা করা। অন্যকে রোজার রাখা ও নক আমলের বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করা । মসজিদ ও মসজিদের উপকরণসমূহ রমজানের পূর্বেই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার কাজে সহযোগিতা করা বাই বিষয়ে পরামর্শ দেওয়া। রমজান মাসে প্রতিবেশী ও দরিদ্রদের মাঝে কিভাবে ইফতার বিতরণ করা যায় সে বিষয়ে পরিকল্পনা তৈরি করা।

মাহে রমজানে চাকুরীজীবীদের প্রস্তুতি: চাকুরীজীবী রমজান মাসে তাদের নিজ নিজ দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি কিভাবে নেক আমল গুলো করা যায় তা পূর্ব থেকে সিদ্ধান্ত নিবেন মনে রাখতে হবে রমজান মাস মানুষকে ভালো হয়ে যাওয়ার ট্রেনিং প্রদান করে তাই নিজ নিজ দায়িত্ব গুলো সঠিকভাবে পালন করার জন্য মানসিকভাবে তৈরি হতে হবে। কর্মব্যস্ততার ভেতরেও কীভাবে বেশি ইবাদাত করা যায়, তার পরিকল্পনা করা উচিত। অফিসের কাজের ফাঁকে ও অফিসে আসার সময় জিকির করতে হবে অফিসে বসে থেকে কাজের ফাঁকে ফাঁকে মোবাইলে কোরআন তেলাওয়াত শুনতে হবে।

মাহে  রমজানে ব্যবসায়ীদের প্রস্তুতি: রমজানে ব্যবসায়ীদের মনে রাখতে হবে যে দরিদ্ররা যেন সহজে কেনাকাটা করে রোজার সেহরি ও ইফতারের আয়োজন করতে পারে, তার জন্য দ্রব্যমূল্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা । কোনোভাবেই একজন ঈমানদার ব্যবসায়ীর উচিত না হবেনা দ্রব্যমূল্যের দাম রমজান মাসে বৃদ্ধি করা বা রমজান মাসে দাম বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যে অধিক মালপত্র মজুদ করা ।
যারা মজুদদারী না করে স্বাভাবিকভাবে ব্যবসা করবে, তাদের এ ব্যবসা পরিণত হবে ইবাদাতে। তার উপার্জন আল্লাহ তা’আলা বরকতময় করে দেবেন। তাকে অপ্রত্যাশিত রিজিক প্রদান করেন।

মাহে রমজানের আর্থিক প্রস্তুতি: রমজান আর্থিক ইবাদাতেরও এক অপূর্ব সুযোগের মাস। এ মাসে রোজা রাখার পাশাপাশি দান-খয়রাত করাও এবাদত এর কাজ। পাড়া-প্রতিবেশী ও দরিদ্র আত্মীয়-স্বজনের কাছে ইফতারসহ নিত্যপণ্য কিনে পাঠানোর মাধ্যমে আল্লাহ তা’আলার সন্তুষ্টি অর্জন করা যায়। রাসূল (সা.) বলেন, ‘কেউ কোনো রোজাদারকে ইফতার করালে সে উক্ত রোজাদারের সমান সওয়াব পাবে। তবে এতে সে রোজাদারের সওয়াব একটুও কমবে না’ (তিরমিজি: ৩/১৭১)। তাই প্রতিটি মুসলমানের উচিত রমজানে একটা পরিকল্পনা করা যাতে কিছু টাকা জমিয়ে তা দিয়ে অভাবী প্রতিবেশী কিংবা আত্মীয়-স্বজনের ঘরে  কিছু ইফতার ও খাদ্যসামগ্রী পাঠানো যায়। যাদের উপর যাকাত ফরজ, তাদের আগে থেকেই রমজান সুষ্ঠুভাবে যাকাত প্রদান করার পরিকল্পনা করতে হবে।

Related Articles